• Image Not Found
    Field Visit to Pabna Mental Hospital (Year:2022)

    পাবনা মানসিক হাসপাতালে ঢাবি শিক্ষার্থীরা

    মানসিক হাসপাতাল শুনলেই মানসপটে সাধারণ কিছু চিত্র ভেসে ওঠে। শৃঙ্খলিত জীবন, বৈদ্যুতিক শক, অনাহারে থাকা, শিকল দিয়ে বাঁধা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, হিংস্রতা ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের মধ্যেও কমবেশি এ ধারণাই ছিল। সম্প্রতি পাবনা মানসিক হাসপাতাল সরেজমিনে পরিদর্শন না করলে হয়ত সেই ধারণা কোনওদিন মন থেকে যেত না। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের ৩য় ব্যাচের শিক্ষার্থীরা গিয়েছিলাম দেশের সর্ববৃহৎ মানসিক হাসপাতাল পরিদর্শনে। লক্ষ্য পুঁথিগত বিদ্যার সাথে ব্যবহারিক জ্ঞান আহরণ। সাথে ছিলেন দুজন প্রিয় শিক্ষক। শোনাচ্ছি সেই গল্প।

    পেছনের ইতিহাস শোনালেন পাবনা মেডিক্যাল কলেজের সহকারি অধ্যাপক এবং অন্যতম প্রধান মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো. জোবায়ের মিয়া। পাবনা মহকুমার তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. হোসেন গাঙ্গুলির অনুপ্রেরণা ও নিরলস প্রচেষ্টার ফলে ১৯৫৭ সালে পাবনা শহরের অদূরে শীতলাই হাউসে ৬০টি বেড নিয়ে পাবনা মানসিক হাসপাতালের যাত্রা শুরু। পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালে পাবনার হেমায়েতপুরের শ্রী শ্রী অনুকূল ঠাকুরের আশ্রমের পাশে ১১১ একর জায়গা জুড়ে এক মনোরোম পরিবেশে ২০০টি বেড নিয়ে হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ধীরে ধীরে এটি ৪০০ এবং সময়ের আবর্তনে বর্তমানে ৫০০ বেডের একটি পুর্ণাঙ্গ হাসপাতাল।

    সম্প্রতি মানসিক হাসপাতালের জায়গায় স্থাপিত হয়েছে আধুনিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।

    অবকাঠামো ও সুযোগ সুবিধা

    বর্তমানে হাসপাতালটিতে ৪ জন সাইক্রিয়াটিস্ট, ১ জন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, ৩ জন সাইক্রিয়াট্রিক সোস্যাল ওয়ার্কার কাজ করছেন। হাসপাতালটি আউটডোর ও ইনডোর দু’ভাগে বিভক্ত। আউটডোরে সব ধরনের রোগী দেখা হয় এবং ইনডোরে রোগী ভর্তি করা হয়। এই হাসপাতালে বর্তমানে ১৮টি ওয়ার্ড রয়েছে, যার মধ্যে ১৩টি পুরুষ এবং ৫টি মহিলা। পুরুষ ওয়ার্ডের মধ্যে ২টি পেয়িং ওয়ার্ড। এর ১টি বরাদ্দ মাদকাসক্ত রোগীর জন্য, অন্যটি জেনারেল ওয়ার্ড। মহিলা ওয়ার্ডগুলোর মধ্যে ৪ টি বিনামূল্যে আর ১টি পেয়িং। মোট তিনটি পেয়িং ওয়ার্ডে বেডের সংখ্যা ১৫০। অর্থাৎ ৩৫০টি বেডই বিনামূল্যে রোগীদের জন্য। প্রতিটি ওয়ার্ডে রোগীদের বিনোদনের জন্য রয়েছে ডিস সংযোগসহ রঙিন টেলিভিশন। সবার জন্য আছে চারবেলা উন্নত পরিবেশে রান্না করা পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা। ইনডোরে ভর্তিকৃত রোগীরা সুস্থ হলে তাদের অকুপেশনাল ডিপার্টমেন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ যেমন, তাতের কাজ, কাঠের কাজ, সেলাই ও কম্পিউটার চালানো, দেয়া হয়। সাথে খেলাধূলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা তো রয়েছেই।

    রোগীরধরন ও চিকিৎসাপদ্ধতি

    এখানে মূলত রেফারকৃত ও পরিবারের মাধ্যমে স্বেচ্ছায় উভয় ধরনের রোগী চিকিৎসার জন্য আসে। এছাড়া সাধারণ কিছু শারীরিক উপসর্গ (যেমন জ্বর, চর্মরোগ) নিয়েও অনেকে আসে। রোগের ধরন বুঝে সব রকম পরামর্শই প্রদান করা হয় ও সাধ্য অনুযায়ী চিকিৎসা দেয়া হয়। কিছু রোগীকে শুধুমাত্র ঔষধ প্রয়োগ করে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। অনেককে মেডিসিন প্রয়োগের পাশাপাশি সাইকোলজিক্যাল সাহায্য দেওয়া হয়। আর গুরুতর রোগীদের ওয়ার্ডে ভর্তির সুপারিশ করা হয়। সাইকিয়াট্রিস্ট, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, সোস্যাল ওয়ার্কার ও অন্যান্য নার্সিং স্টাফদের সমন্বয়ে গঠিত পেশাদারদের একটি টিম প্রতিদিন বহির্বিভাগ থেকে কমপক্ষে ১০০ থেকে ১৫০ টি রোগীকে এভাবে চিকিৎসা প্রদান করেন।

    রোগী ভর্তির প্রক্রিয়া

    এখানে বর্তমানে তিন ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত রোগীকে ভর্তি রেখে সেবা প্রদান করা হয়। এর জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট কিছু প্রক্রিয়া। সিজোফ্রেনিয়া, বাই-পোলার মুড ডিজঅর্ডার এবং মাদকাসক্তিতে আক্রান্ত রোগীদের ভর্তি করানো হয়। আউটডোরে সব ধরনের রোগী দেখা হলেও ইনডোরে রোগী ভর্তি করানো হয় কিছু শর্তের মাধ্যমে। যেমন ১৮ বছরের নিচে ও ৫০ বছরের উর্ধ্বে, বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী, মৃগী রোগী এবং শারীরিক কোনও কঠিন রোগে আক্রান্ত রোগীদের ভর্তি করানো হয় না। একজন রোগীকে কমপক্ষে ২ মাস হাসপাতালে রাখা হয়। ধরন অনুযায়ী কোনও কোনও রোগীকে ৩ থেকে ৪ মাসও রাখা হয়। রোগীকে দেখাশোনার জন্য পরিবারের কাউকে রাখার প্রয়োজন হয় না। ভর্তির সময় রোগীর নাগরিক সনদপত্র এবং কিছু টাকা জামানত হিসেবে দিতে হয়।

    জামানতের টাকা?

    আমাদের প্রশ্ন শুনে হাসি মুখে উত্তর দিলেন হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট মেজবাহ-উল-হক। 'রোগী সুস্থ হওয়ার পর বাড়ি চলে যাবে এটাই নিয়ম। কিন্তু অনেকক্ষেত্রে দেখা গেছে পরিবাবের লোকজন ভর্তির সময় ভুল ঠিকানা দিয়ে যায়। রোগী ভালো হলেও তারা নিতে আসেন না। এরপর থেকে আমরা জামানতের ব্যবস্থা চালু করেছি। পরিবাবের কেউ না এলে আমরাই তাদের বাসায় পৌঁছিয়ে দিয়ে আসি সেই টাকা দিয়ে।' আর এ জন্য বাবা-মা, আপন ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী ছাড়া অন্য কেউ রোগীর অভিভাবক হতে পারবে না। যদি এরকম কেউ না থাকে তবে নিকটতম অন্য কেউ নোটারি পাবলিক অথবা চেয়ারম্যানের নাগরিক সনদপত্র নিয়ে অভিভাবক হতে পারবেন। মাদকাসক্ত রোগীদের জন্য বিনামূল্যে কোনও বেড নেই। এদের ভর্তির সময় ১ মাসে ৮০২৫ টাকা করে ২ মাসের জন্য ১৬০৫০ টাকা জমা দিতে হয়।

    একটি অতীত ইতিহাস

    হাসপাতাল পরিদর্শনের সময় হঠাৎ করেই এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াতে হলো। দেখতে পেলাম লোহার গেট দিয়ে আটকানো অন্ধকার কিছু ঘর। এগুলোই মূলত পাগলাগারদ হিসেবে পরিচিত ছিল। যেখানে সমস্যাগ্রস্ত মানুষগুলো এসে মোটেও উপকৃত হত না। বরং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রোগের মাত্রা আরো বেড়ে যেত। বর্তমানে এই ঘরগুলো অফিসের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।

    হাসপাতালের বর্তমান পরিবেশ

    সেই পাগলাগারদ আজ শুধুই স্মৃতি। সুস্থ হওয়ার মতো সব ধরনের পরিবেশই আজ বিদ্যমান সেখানে। শহরের অদূরে একটি নির্মল দূষণমূক্ত পরিবেশে হাসপাতালটির অবস্থান। পুরো প্রান্তর জুড়ে সবুজের সমারোহ। হাসপাতালটির লাল রং দূর থেকেই যে কোনও মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। হাসপাতালের ভিতরের পরিবেশ আরো সুন্দর। ফুলের বাগান আর সবুজের সমারোহ দেখে বোঝার উপায় নেই এটি একটি হাসপাতাল। সাজানো গোছানো আর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এই হাসপাতালটি নিজ গুণেই অন্য আর দশটি হাসপাতাল থেকে ভিন্ন। অভ্যন্তরীণ বিভাগের প্রতিটি জায়গায় রয়েছে পরিপাটির ছাপ। অত্যন্ত খোলামেলা ও প্রাকৃতিক আলো বাতাসে ভরপুর এ জায়গাটিতে শুধু মানসিক সমস্যাগ্রস্ত নয়, যে কোনও স্বাভাবিক মানুষের মন ভালো হয়ে যায়।

    দু’দিনের অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের মনে হয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় বিশাল এই হাসপাতালটিতে প্রশিক্ষিত জনবলের সীমাহীন সংকট। সাইকিয়েট্রিস্ট, ক্লিনিক্যাল এবং কাউন্সেলিং সাইকোলজিসস্টসহ অন্যান্য পেশার জনবল পর্যাপ্ত পরিমাণে বাড়ানো প্রয়োজন।

    সীমাবদ্ধতা আছে, থাকবেই। আমরা আন্তরিকতাটাকেই বড় করে দেখব। অত্যন্ত সীমিত জনবল ও অবকাঠামো নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিশ্রুত অবিরাম সেবার যে নিরলস প্রচেষ্টাটি চালিয়ে যাচ্ছে এক কথায় তা অতুলনীয়। মানসিক রোগ অন্যান্য শারীরিক রোগের মতোই একটি রোগ। তাই মানসিক রোগকে আর অবহেলা নয়। নিজের মনের যত্ন নেব। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেব, মানসিক রোগীকে সম্মান করব, পাশে এসে দাঁড়াব।

    সহ-লেখক: অনন্যা ফিরোজ, আতকিয়া ইব্বান তামান্না তরমিম,চিন্ময় কুমার মণ্ডল, তাজরীন আক্কাস জিনিয়া, তানভির আহমেদ শুভ, তাসনিয়া তাবাসসুম এলিজা, নইমা আকতার, নুসরাত জাহান, প্রিয়াংকা শঙ্কর দাস, পলাশ বিশ্বাস, ফারহানা আফরিন, ফিরোজ আলম, এস এম ফজলে এলাহী, বিলকিস খানম, মাসুমা আক্তার সুমি, মাহমুদ হাসান, মোস্তাক আহমেদ, রিয়াদ হোসেন তুষার, রীভা মীর, রেজাউল ইসলাম, রেজাউল করিম, রনতী চক্রবর্তী, লিনা খাতুন, শারমিন সুলতানা, শাহীন আলম, মোঃ পারভেজ সাজ্জাদ পিন্টু, সাদিয়া আফরিন, সিনথিয়া পারভীন, শারমিন আকতার লেখকগণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী

     

    ড. মো. আজহারুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক, ডিইসিপি

    প্রথম প্রকাশঃ বাংলা ট্রিবিউন