ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে গতকাল ২৩ অক্টোবর ২০২১ তারিখ শনিবার সন্ধ্যায় ‘হাফিজ শিরাজি: প্রেম ও রহস্যের কবি’ শীর্ষক একাডেমিক ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়। এটি ছিল বিভাগের শতবর্ষ পূর্তির ধারাবাহিক ওয়েবিনারের পঞ্চম পর্ব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-উপাচার্য (প্রশাসন) ও দেশের বিশিষ্ট কবি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ প্রধান অতিথি হিসেবে ওয়েবিনার উদ্বোধন করেন। ওয়েবিনারে মূল বক্তা ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন এবং আলোচক ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ও জাতিসত্তার কবি জনাব মুহম্মদ নূরুল হুদা। ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন ওয়েবিনারে সভাপতিত্ব করেন ও মডারেটরের দায়িত্ব পালন করেন।
ওয়েবিনার উদ্বোধন করে কবি মুহাম্মদ সামাদ বলেন, মহাকবি হাফিজ ছিলেন মানবতার কবি, প্রেমের কবি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাফিজের ভক্ত-অনুরাগী ছিলেন। তিনি হাফিজকে সম্মান করতেন এবং দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অনেক কষ্টে হাফিজের মাজারে যিরারত করতে গিয়েছেন। হাফিজের প্রতি এই অনুরাগ দেখেই বুঝা যায় তিনি কত বড়মাপের কবি ছিলেন। ইরানের বহু আগে কলকাতা থেকে ফারসি পত্রিকা এবং হাফিজের কবিতার অনুবাদ প্রকাশ হয় এ তথ্য দিয়ে তিনি শুভাস মুখোপাধ্যায়ের নামোল্লেখ করেন; যিনি হাফিজের কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেছেন। তিনি ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রশংসা করেন এবং শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে এ ধরনের উদ্যোগে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন মূল প্রবন্ধে বলেন, হাফিজ ছিলেন আধ্যাত্মিক প্রেমের কবি। তিনি মানুষের দুঃখ বেদনায় শোকাতুর হয়েছেন। এজন্যই তিনি বিশ্বপ্রেমের কবি। তিনি ব্যথিত মানুষের হৃদয়ে তাঁর কবিতার মাধ্যমে শান্তনার প্রলেপ দিতে চেয়েছেন। হাফিজ লৌকিকতা বিরোধী ছিলেন, প্রচলিত ধর্মপন্থীদের বিরুদ্ধে ছিলেন। প্রবন্ধকার বলেন, হাফিজ মানবতার যে নিদর্শন আমাদের জন্য রেখে গেছেন সে আলো আমাদের জীবনের বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারলে পৃথিবী থেকে হানাহানি, হিংসা, বিদ্বেষ দূর হবে।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ও বরেণ্য কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, হাফিজ সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে অন্যতম। হাফিজের কবিতা, গজল, গান এত নান্দনিক যে মানের দিক থেকে অন্যদের গান, গজল বা কবিতা থেকে পুরোপুরিই আলাদা। তিনি ছিলেন মুলত প্রেমের কবি। তাঁর প্রেম ছিল ঐশ্বরিক। কবি নজরুল হাফিজকে ধারণ করেছিলেন। হাফিজ যে প্রেমের বীজ বপণ করে গেছেন তা থেকে নজরুল উপাদান সংগ্রহ করেছেন, রচনা করেছেন হাফিজর অনুসরণে বিদ্রোহী কবিতা। তিনি আরো বলেন, হাফিজ আধ্যাত্মিক চেতনার কবি; তাঁর কবিতায় ঐশ্বরিক বিষয়াদি স্থান পেয়েছে। আর সেজন্যই তিনি মানবতার কবি হিসেবে নিজেকে উপস্থাপনে সফল হয়েছেন।
ওয়েবিনারের মডারেটর ও সভাপতি, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন স্বাগত বক্তব্যে বলেন, হাফিজ প্রেম, রহস্য ও মানবতার কবি। তাঁর জীবন ও কাব্যে ফুটে ওঠেছে বিশ্বমানবতার জয়গান, সর্বজনীন ভালোবাসার অপার মহিমা। বিশ্বজনীন প্রেম ও উদারনৈতিক জীবনদর্শন বর্ণনার পাশাপাশি ধর্মীয় গোড়ামি, উগ্রবাদ ও বকধার্মিকদের কপটতার স্বরূপও তিনি উন্মোচন করেছেন। বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহকে পাঠিয়েছিলেন তাঁর রচিত কবিতা, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর পরিবারে ছিল হাফিজ চর্চা এবং আমাদের জাতীয় কবি নজরুলের উপরে ছিল হাফিজের প্রভাব; তাই মহাকবি হাফিজ শিরাজি আজো আমাদের সমাজ-সভ্যতার জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক।
এছাড়া আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশের শিল্প-বাণিজ্য অঙ্গনের পুরোধা, মানবসেবায় একুশে পদকপ্রাপ্ত মনীষী, পিএইচপি গ্রুপের চেয়ারম্যান আলহাজ সুফি মুহাম্মদ মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, হাফিজ পশু ও মানুষের মধ্যকার এবং ফেরেস্তা ও মানুষের মধ্যকার পার্থক্য তাঁর প্রেমতত্ত্ব দ্বারা বিশ্লেষণ করে অমর হয়ে আছেন। হাফিজ বলেছেন, মানুষের দুটি স্বভাবের মধ্য থেকে যে স্বভাবটি স্বপ্রণোদিত হয়ে উঠে আসে সেটিই হচ্ছে প্রকৃত মানবীয় স্বভাব, অন্যটি হচ্ছে পশুর স্বভাব। তিনি আরো বলেন, হাফিজ তাঁর কর্ম দ্বারা সারাবিশ্বে সমাদৃত হয়েছেন। তিনি দেশ ও জাতি গঠনে কর্মে নিষ্ঠাবান হওয়ার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান।
ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান বলেন, হাফিজের দর্শনের মূল ভিত্তি ছিল পবিত্র কুরআন। হাফিজ তাঁর মতাদর্শে পবিত্র কুরআনকে সামনে রেখেই দর্শন সৃষ্টি করেছেন। এ কারণেই সকল ধর্ম-বর্ণ, সম্প্রদায়ের কাছেই হাফিজের দর্শন সাদরে গৃহীত হয়েছে।
ওয়েবিনারে রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষার্থীবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।
(মাহমুদ আলম)
পরিচালক
জনসংযোগ দফতর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়