প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ১০ অক্টোবর “বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস-২০২১” উদ্যাপন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি সোসাইটি এবং ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়-এর যৌথ উদ্যোগে আগামী ১০, ২৯ ও ৩০ অক্টোবর এবং ৫ নভেম্বর ২০২১ চার দিন ব্যাপি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এ বছরের বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘অসম বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য’। উক্ত অনুষ্ঠানের মধ্যে ১০ অক্টোবর, ২০২১ রোজ রবিবার সকাল ১১:০০ টায় একটি ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ওয়েবিনারে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান মিসেস জোবেদা খাতুন, মূল প্রতিপ্রাদ্য উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি সোসাইটির সভাপতি ড. মুহম্মাদ মাহমুদুর রহমান, বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল, অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অংলকৃত করেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব মোঃ সায়েদুল ইসলাম এবং সভাপতিত্ব করেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের প্রকল্প পরিচালক এ, কে, এম, শামীম আক্তার।
ওয়েবিনারে স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান মিসেস জোবেদা খাতুন বলেন, শারীরিক স্বাস্থ্যের মত মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যা করা প্রয়োজন। তবে বিশ্বজুড়েই মানসিক স্বাস্থ্যর বিষয়টি অনেকটাই অবহেলিত। তিনি এ ব্যপারে সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে এগিয়ে আসার আহবান জানান। স্টিগমা ও কুসংস্কার দূর করে প্রত্যেকটা মানুষের কাছে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছানোর বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান করেন। কমিউনিটি লেভেলে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের বিষয়টিও তিনি উল্লেখ করেন।
ওয়েবিনারের মূল প্রতিপ্রাদ্য উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি সোসাইটির সভাপতি ড. মুহম্মাদ মাহমুদুর রহমান। তিনি তাঁর আলোচনায় বলেন আমরা দু’ধরণের বৈষম্যের সন্ধান পাই: প্রথমত, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুক্তভোগী এক বিশাল সংখ্যা যথাযথ মানসিক স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকা জনিত বৈষম্য, এবং দ্বিতীয়ত রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক অর্থনৈতিক নীতিমালার ফলে সৃষ্ট একই দেশের বিভিন জনগোষ্ঠীর মধ্যে আর্থ সামাজিক বৈষম্য, জীবন যাত্রার সকল চাহিদা ও মান বজার রাখার অক্ষমতা, ইত্যাদি হতে সৃষ্ট মানসিক চাপ বৃদ্ধি এবং নানা প্রকার মানসিক সংকটে ভোগা ও সংকটপূর্ণ জীবনযাপন। তিনি আরও উল্লেখ করেন ঐতিহাসিকভাবে বিচার করলে এটা দেখা যায় যে মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারটিকে সর্বদাই কম গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে একটি বিরাট সংখ্যক মানসিক সমস্যা বা অসুস্থতায় আক্রান্ত মানুষদের সঠিক ও বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা বঞ্চিত থেকে দিনের পর ভোগান্তি, যা তাদের জীবন যাত্রার মানকে নিন্ম স্তরে নামিয়ে রেখেছে। কোভিড-১৯ মহামারির আর্থ-সামাজিক প্রভাবেও দেখা গেছে যে, দারিদ্র ও বৈষম্যের শিকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার প্রকোপও অতিমাত্রায় বেড়েছে।তিনি উল্লেখ করেন সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার শতকরা ১৭ ভাগ মানুষ কোননা কোন মানসিক অসুস্থতায় ভুগছে, এর মধ্যে মাত্র ৮% মানুষ পাচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা ও ৯২% মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্য সেবাহতে। এই পরিস্থিতি দূর করতে একদিকে যেমন বাড়াতে হবে মানসিক স্বাস্থ্য সেবার মান, তেমনি অন্যদিকে মানসিক চাপ ও মানসিক স্বাস্থ্য হানির গভীর কারণসমূহ দূর করার জন্য নিতে হবে গবেষণালব্ধ কার্যকর স্ট্রাটেজি। যেখানে আমাদের জাতীয় লক্ষ্য হতে হবে আগামী দশ থেকে বিশ বছরের মধ্যে দেশে মানসিক রোগীর হার ৭% এ নামিয়ে আনার ব্যবস্থা করা।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অংলকৃত করেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব মোঃ সায়েদুল ইসলাম। তিনি বলেন সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে পিতামাতার প্যারেন্টিং-এর দক্ষতা গড়ে তোলা গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি তিনি বর্তমান সরকারের প্রাইমারি লেভেলে চিকিৎসা খাতে উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
ওয়েবিনারে বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল। বিশেষ অতিথি তাঁর বক্তব্যে বলেন যে, করোনাকালীন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ অনলাইনে ফ্রী মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করে সাধারণ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা করছে। তিনি আরো বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে আইন প্রণয়ন করে প্রাইমারী লেভেল থেকে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। মানসিক সমস্যা নিরসনে সামাজিক বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে তিনি মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের বিষয়টি সম্প্রসারণ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
আজকের ওয়েবিনারে সভাপতি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের প্রকল্প পরিচালক এ, কে, এম, শামীম আক্তার বলেন, প্রতিযোগিতামূলক এই বিশে^ যেখানে ক্রমাগত সমাজের অসম বন্টনের বিষয়টি রয়েছে, একই সাথে চলমান কোভিড পরিস্থিতির অভিঘাত সবচেয়ে বেশী আঘাত হেনেছে সমাজে তুলনামূলকভাবে কম সুবিধা ভোগীবানিন্ম , নিন্মমধ্যম, মধ্যম এমনকি উচ্চ মধ্যম আয়ের শ্রেনীর মানুষদের। এই অভিঘাত যতটা না আর্থিক তারচে বেশী মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে বিশেষ করে কিশোর-যুব ও নারীদের। এ বিবেচনায় এ বছরের প্রতিপাদ্য যথার্থতা সহজেই অনুমেয়। তিনি আরও বলেন, প্রতিযোগিতামূলক এই বিশ্বেও অনিবার্য পরিনতি যে অসাম্য বা সামাজিক অসমতা-তার অভিযাতে সৃষ্ট মানসিকভাবে অস্থিরতা ও সমস্যাক্রান্ত বাংলাদেশের জনগণ বিশেষত: যুবসমাজ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্থ্য মানবিক স্বাস্থ্য গঠনে কার্যকর, কৌশলী ও প্রয়োগ মূখী করার ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তিনি আরও বলেন, মনোবিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের সর্বসাধারণের মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ ১৯৯৭ সালে যাত্রা শুরু করে। সুন্দর মানুষ গড়ার পাশাপাশি, মানসিক স্বাস্থ্যকে মূলধারায় নিয়ে আসার প্রচেষ্টার এই বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীবৃন্দ গবেষণা ও সেবার মাধ্যমে সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে চলেছেন। চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী ও সহকারী চিকিৎিসা মনোবিজ্ঞানীরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ এবং বাংলাদেশ ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি সোসাইটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ইতিবাচক মনোভাব গঠন, মানসিক সমস্যা নিরসন এবং দক্ষ মানসিক পেশাজীবী তৈরী করার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক অবদান রাখবে এবং প্রতিযোগিতামূলক এই বিশ্বের অনিবার্য পরিনতি যে অসাম্য বা সামাজিক অসমতা-তার অভিযাতে সৃষ্ট মানসিকভাবে অস্থিরতা ও সমস্যাক্রান্ত বাংলাদেশের জনগণ বিশেষত: যুবসমাজ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্থ্য মানবিক স্বাস্থ্য গঠনে কার্যকর, কৌশলী ও প্রয়োগমূখী ভূমিকা রাখবে।
এছাড়া ১০ অক্টোবর, ২০২১ রাত ৮.০০ টা এবং ৯.৩০ টায় মানসিক স্বাস্থ্য ও এবারের প্রতিপাদ্যের উপর দুটি Facebook Live অনুষ্ঠিত হবে। আগামী ২৯ ও ৩০ অক্টোবর এবং ৫ নভেম্বর ২০২১ তারিখে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে অনলাইন জুমে অনুষ্ঠিত হবে গুরুত্বপূর্ণ ও যুগোপযোগী আরো ১১টি কর্মশালা। কর্মশালা সমূহের মধ্যে রয়েছে:
১. আপনি কি নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট? আমাকে নিয়ে আমি যেভাবে ভালো থাকতে পারি
২. মনোজগতের পুনর্নির্মাণের মাধ্যমে কি জীবনের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব?
৩. আমাদের জীবনের গল্প আমরাই সাজাই: আত্মহত্যা প্রতিরোধ করি
৪. Neuropsychological Consequences of Stroke.
৫. জীবনকে ভালোবাসুন- মানসিকভাবে সুখী ও অর্থপূর্ণ জীবন গড়ুন
৬. দুই প্রজন্মের সেতুবন্ধনঃ দূরত্ব নয় বন্ধুত্ব
৭. করোনাকালে সন্তান প্রতিপালনে আপনি কী করবেন?: কিছু অহিংস কৌশল জানুন
৮. করোনায় মানসিক সুস্বাস্থ্য: কী করতে পারি আমরা?
৯. নারী ও পুরুষের মনো:যৌন সমস্যা: মনোবৈজ্ঞানিক সমাধান ও করণীয়
১০. Borderline Personality Disorder: Myths and Reality
১১. রোমান্টিক সম্পর্কের উন্নয়ন: আপনার করণীয় কি?
ধন্যবাদান্তে
জোবেদা খাতুন
চেয়ারম্যান
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়