জাতীয় অধ্যাপক ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এম আর খান (৮৮) এর মৃত্যুতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
গতকাল ৫ নভেম্বর ২০১৬ শনিবার এক শোকবাণীতে উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ডা. এম আর খান জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশের শিশুচিকিৎসার অন্যতম পথিকৃৎ। তাঁর উদ্যোগে জাতীয়ক্ষেত্রে যেমন শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন গড়ে উঠেছে তেমনি দেশের বিভিন্ন স্থানে স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন নানা প্রতিষ্ঠান। ধূমপান বিরোধী আন্দোলন এবং দেশ থেকে পোলিও নির্মূলে তার উদ্যোগী ভূমিকা রয়েছে। প্রকৃত দেশপ্রেমিক হিসেবে সামাজিকভাবে এবং বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান জাতি স্মরণ রাখবে।
উপাচার্য মরহুমের রূহের মাগফেরাত কামনা করেন এবং তাঁর পরিবারের শোক-সন্তপ্ত সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
অধ্যাপক এম আর খানের জন্ম ১৯২৮ সালের ১ আগস্ট সাতক্ষীরার রসুলপুরে। তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আইএসসি পাস করার পর ১৯৪৪ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৫২ সালে এমবিবিএস পাস করেন। এরপর তিনি যুক্তরাজ্যের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিটিএমঅ্যান্ডএইচ (১৯৫৭), লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিসিএইচ (১৯৫৭), এডিনবরা থেকে এমআরসিপি (১৯৬২), ঢাকার ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিসিন এন্ড রিসার্চ (আইপিজিএমআর) থেকে এফসিপিএস (১৯৭৪) এবং এডিনবরা থেকে এফআরসিপি (১৯৭৮) ডিগ্রি লাভ করেন।
বিদেশে পড়াশুনা শেষ করে ১৯৫৭ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার কেন্ট ও এডিনবরা গ্রæপ হাসপাতালে যথাক্রমে সহকারী রেজিস্ট্রার ও রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দেশে ফিরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক পদে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগে যোগ দিয়ে পরের বছর অধ্যাপক হন। ১৯৭১ সালে তিনি ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিসিন এন্ড রিসার্চ-আইপিজিএমআরের অধ্যাপক ও ১৯৭৩ সালে এই ইনস্টিটিউটের যুগ্ম-পরিচালকের দায়িত্ব পান। ডা. খান ১৯৭৮ সালের নভেম্বরে ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালকের পদে যোগ দেন। শিশুদের জন্য বিশেষায়িত এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায়ও তাঁর ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ওই বছরই আবার আইপিজিএমআরের শিশু বিভাগে যোগ দেন তিনি। দীর্ঘ চাকরি জীবন শেষে ১৯৮৮ সালে অধ্যাপক এম আর খান অবসর নেন।
অধ্যাপক এম আর খান ১৯৭৩ সালে পিজিতে ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন এন্ড মেডিকেল রিসার্চ (আইপিজিএমআর) এবং শিশু স্বাস্থ্য ও চিকিৎসায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি কোর্স (এমসিপিএস, ডিসিএইচ ও এফসিপিএস) চালু করেন। তাঁর তত্ত¡াবধানে থেকে সাত শতাধিক ছাত্রছাত্রী শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
(অপর পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)
এম আর খান চাকুরিজীবন শেষে প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থ দিয়ে গড়ে তোলেন ডা. এম আর খান-আনেয়ারা ট্রাস্ট। দুস্থ মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা, তাদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে এ ট্রাস্টের মাধ্যমে তিনি কাজ করে গেছেন। তাঁর উদ্যোগে গড়ে উঠেছে জাতীয় পর্যায়ের শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন। প্রতিষ্ঠা করেছেন শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। গড়ে তুলেছেন সাতক্ষীরা শিশু হাসপাতাল, যশোর শিশু হাসপাতাল, সাতক্ষীরা ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার, রসুলপুর উচ্চবিদ্যালয়, উত্তরা উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা সেন্ট্রাল হাসপাতাল, নিবেদিতা নার্সিং হোমসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। এছাড়া তিনি দেশ থেকে পোলিও দূর করতে উদ্যোগী ভূমিকা রেখেছেন, কাজ করেছেন ধূমপানবিরোধী আন্দোলনের সংগঠন ‘আধূনিক’-এর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে।
প্রতিষ্ঠানতুল্য ডা. এম আর খানের জীবনী স্থান পেয়েছে কেমব্রিজ থেকে প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল হু ইজ হু অব ইন্টেলেকচুয়ালে। বাংলাদেশে শিশু স্বাস্থ্যের ওপর এফসিপিএস, ডিসিএইচ ও এমসিপিএস (গঈচঝ) ডিগ্রি পরীক্ষার পরীক্ষক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া, তিনি দেশ-বিদেশে উল্লেখযোগ্য মেডিকেল কলেজের উচ্চতর ডিগ্রি/সম্মান দেওয়ার ক্ষেত্রে পরীক্ষক হিসেবেও কাজ করছেন।
এম আর খান শিশুরোগ চিকিৎসা ও সমাজ সেবার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার, ইন্টারন্যাশনাল ম্যানিলা অ্যাওয়ার্ডসহ অসংখ্য পুরস্কার। ১৯৮৭ সালে যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজে বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টার থেকে প্রকাশিত প্রকাশনায় তার জীবনপঞ্জি অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৯১ সালে ম্যানিলাভিত্তিক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের অ্যাসোসিয়েশন অব পেডিয়াট্রিকস থেকে পদক পান তিনি। ১৯৯২ সালে তিনি শেরে বাংলা জাতীয় স্মৃতি সংসদ কর্তৃক স্বর্ণপদক গ্রহণ করেন। এছাড়াও শিক্ষা, চিকিৎসা, শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষা, দুর্গত অসহায় মানুষের সেবাসহ সমাজকল্যাণমূলক কাজে অসামান্য অবদান রাখায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ডা. এম আর খানকে সৃম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছে ও বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি স্বর্ণপদকে ভূষিত করেছে। ১৯৯৪ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি সরকার কর্তৃক দেশের ‘জাতীয় অধ্যাপক’ নির্বাচিত হয়েছেন।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে এম আর খানের ৩৭টি গবেষণাধর্মী রচনা প্রকাশিত হয়েছে। শিশুরোগ চিকিৎসা সংক্রান্ত এসেন্স অব পেডিয়াট্রিকস, ড্রাগ রোপি ইন চিলড্রেন, এসেন্স অব এন্ডোক্রিনোলজি, আপনার শিশুর জন্য জেনে নিন, মা ও শিশুসহ তাঁর লেখা আটটি বই রয়েছে যেগুলো দেশে ও বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে।
উল্লেখ্য, ডা. এম আর খান গতকাল শনিবার বিকেলে রাজধানীর একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এম আর খান বার্ধক্যজনিত নানা জটিল রোগে কয়েক মাস ধরে ভুগছিলেন। তাঁর প্রথম নামাজে জানাজা আজ রবিবার সকাল সাড়ে ১০টায় সেন্ট্রাল হাসপাতালে অনুষ্ঠিত হবে। এরপর বেলা সাড়ে ১১টায় জানাজা অনুষ্ঠিত হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে। দুপুর ১২টায় বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) কার্যালয়ে এবং সাড়ে ১২টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সবার শ্রদ্ধা জানানোর জন্য নেওয়া হবে তাঁর মরদেহ। এরপর বেলা ২টা ৩০মিনিটে মিরপুরে শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন এবং সাড়ে তিনটায় উত্তরা উইমেন্স মেডিকেল হাসপাতালে তাঁর জানাজা হবে। এরপর মরদেহ নিযয়ে যাওয়া হবে গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার রসুলপুরে। পথে রাতে যশোরে শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশনে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। আগামীকাল সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় এম আর খানের নিজের গ্রাম রসুলপুরে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হবে।
-----------------
পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত)
জনসংযোগ দফতর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়